কতই বা বয়স তখন? নয়ে পা দিয়েছি সবে। মোবাইল তো দূরের কথা, আমাদের গ্রামের দিকে টি ভি নামক বোকাবাক্সটাও তখন ছিল মরীচিকার মতো। বাবা, কাকুদের সন্ধ্যা বেলার নাটমন্দিরের তাসের আসরে হ্যারিকেন, লণ্ঠন, তালপাতার পাখা, বেগুনি মুড়ি চায়ের সাথে একটা ছোট্ট রেডিও ও থাকতো। দিনের বেলায় যেটা ছিল আমাদের মতো ছোটদের দখলে। এই তাসের দলে মাঝে মাঝেই ঝগড়া লেগে যেত। একটাই কমন কথা আজও মনে লেগে আছে– "তুই খেলার খ বুঝিস? এখানে ট্রাম্প করবি না? কাল থেকে একদম খেলার জন্য আমাকে ডাকবি না।" মানে বুঝতাম না তখন। ভাবতাম কি ঝগড়ুটে লোক রে সবাই! পরের দিন সবাই এসে আগের মতো ঠিক জুটে যেত।
তা এ হেন তাসের আসরে একদিন সবাই উপস্থিত কিন্তু খেলা হচ্ছে না। সবাই চিৎকার করছে। সে দিনই প্রথম মাটির বাড়ির দোতলার জানালায় কান পেতে শুনতে পেলাম অমল দত্তর নাম। ডায়মন্ড সিস্টেম, চিমা ওকরি, পি. কে. ব্যানার্জী, বাইচুঙ ভুটিয়া এই গুলোই কানে আসছিলো বেশী।আর কানে এলো "ফুটবল" কথাটা।
পরে রাত্রে বাবার পাশে বসে খেতে খেতে শুনতে পেলাম ডার্বির কথা। টিকিট জোগাড় হয়ে গেছে প্রায়, বাবা আর তাসকাকুরা সবাই যাচ্ছে খেলা দেখতে। শুনতে পেলাম মোহনবাগানের কথা। ইস্টবেঙ্গল নিয়ে যদিও বা দু একটা কথা বললো বাবা কিন্তু মা কে আধঘন্টা ধরে বসে বুঝিয়েছিল কেন মোহনবাগান এই ম্যাচ টা জিতবে। মায়ের অভিব্যক্তি আজও মনে আছে। কিছু না বুঝেও বিজ্ঞের মতো সে কি ঘাড় নাড়া। আর শেষে সেই অমোঘ প্রশ্নবাণ— শচীন কাদের খেলবে?!
বাবা আর কিছু বলেন নি। সোজা উঠে গিয়ে নিজের ঘরে।
ভীরু ভীরু পায়ে বাবার ঘরে ঢুকে আমার প্রথম কথাটাই ছিল "বাবা মোহনবাগান কে ? আমাকে নিয়ে যাবে?"
          সেই রাত্রে মায়ের কাছে প্রথম বারের জন্য না ঘুমিয়ে বাবার কাছে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। শৈলেন মান্না থেকে চুনী গোস্বামী, জার্নেল সিং থেকে সুব্রত ভটচাজ্ (বাবা ভট্টাচার্য বলেন না )— এঁরা বোধহয় স্বপ্নেও সেদিন আমার সাথে পাড়ার মাঠে খেলছিল। এরপরে রীতিমতো বাড়ি তে লঙ্কাকান্ড। মায়ের হুঙ্কার, আমার জেদ, কান্না এবং শেষে বাবার অভয়ে মায়ের অনুমতি প্রদান।
          অতঃপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। 13 ই জুলাই 1997। তাড়াতাড়ি মাছভাজা আর পান্তা ভাত খেয়ে বাবা আর তাসকাকুদের সাথে খেলা দেখতে বেরিয়ে যাওয়া। ও হ্যাঁ যাওয়ার আগে মা কপালে দই এর ফোঁটাও দিয়েছিলেন আর আধঘন্টা ধরে একটাই কথা বুঝিয়ে ছিলেন — 'বাবার হাত কিন্ত ছাড়বে না'। একই কথা বাবা কেও বুঝিয়েছিলেন। এখন বুঝতে পারি লোকসংখ্যা সম্পর্কে বাবা বা মা কারোরই কোনো ধারণা ছিল না। না হলে বোধহয় খেলা দেখা টা হতো না।         
          যাই হোক, বাদাম মুড়ি, লেবু লজেন্স শসা হজম করে যখন যুবভারতী পৌছোলাম সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। শুধুই কালো কালো মাথা আর মাথা। যদিও আমার আগ্রহ বেশী ছিল ঘোড়ার পিঠে থাকা পুলিশের দিকে। বাবার কাঁধ থেকে শুধুই ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখছিলাম মানুষের ভিড়, কলরব। বাবা ভয় পাচ্ছিল খুবই। যদি হারিয়ে যাই। শেষ পর্যন্ত এসে পৌছোলাম গ্যালারিতে। মানুষ আর মানুষ। খেলা যে খুব ভালো করে দেখতে পেয়েছি তা নয়। তবে খেলা শুরুর সময় থেকে আমার সামনে থাকা মানুষেরা খুবই চিৎকার করছিলো। মনে আছে, হঠাতই আমাদের দিক টা কেমন যেন চুপসে গেলো আর আমাদের ঠিক উল্টোদিকের লোকেদের সে কি চিৎকার! বেশ অনেকটা পরে আবার একই পরিস্থিতি হয়েছিল। আমি বাবার কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম "বাবা মোহনবাগান কি জিতে গেছে?" "না। আমরা হারছি "। সেদিনই মনের মধ্যে বীজ বপন হয়ে গিয়েছিলো "আমরা" মানে "মোহনবাগান"। হঠাত করেই সে কি চিৎকার আমাদের দিকে। একটাই আওয়াজ— "চিমা চিমা "। কোনোরকমে বাবার ফতুয়াটা ধরে আছি। এতক্ষণ ধরে ঝিমিয়ে থাকা মানুষ গুলো কি আসুরিক শক্তিতেই না চিৎকার করছে! কিছু না বুঝে আমিও চিৎকার করছি। ("ইসকা নাম হ্যায় মোহনবাগান" বলিনি যদিও। তবে হ্যাট, হো এগুলো মনে হয় বলছিলাম।)
কিন্তু হায়! হিরোসীমা নাগাসাকি তে বোমাবর্ষণ হয়তো দেখিনি কিন্তু আজও মনে আছে এর কিছুক্ষণ পরেই উল্টোদিকের গ্যালারিতে যেন পরপর দুবার বজ্রপাত হল আর আমাদের দিকে তার অভিঘাত। বাবার চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। তাসকাকুরা চুপ। পাশের কাকুরাও কেউ কাঁদছে। কেউ গেঞ্জি তে মুখ লোকাচ্ছে। আর আমি বোবা দৃষ্টিতে ফ্যালফাল করে তাকিয়ে আছি। বুঝতে পেরেছিলাম আমরা হেরে গেছি। সে দেখেছিলাম বটে একটা দুঃখের সাগর।
          পরে বুঝেছিলাম এই ম্যাচ ঘিরে যে উন্মাদনা তৈরী হয়েছিল সেটাই বোধহয় এক লক্ষ ত্রিশ হাজার লোককে তার অমোঘ আকর্ষণে বিদ্ধ করেছিল। পিকের ভোকাল টনিক vs অমল দত্তর ডায়মন্ড সিস্টেম। ওমালো কে ওমলেট, সোসো কে শসা, বাইচুঙ কে চুং চুং বলা অমল দত্তর মতো উদ্ভাবনী বাতিক্রমী চরিত্র আজকে আর নেই। বাসুদেব, সত্যজিৎ, দুলাল বিশ্বাস, দেবজিৎ, শঙ্করলাল, তুষার রক্ষিত, হেমন্ত ডোরা,অমিতাভ চন্দ,অলক দাস, অমিত দাস,রঞ্জন দে, সৌমিত্র চক্রবর্তী র মতো এক ঝাঁক বাঙালি ফুটবলার সে দিন দু দলের হয়ে মাঠে নেমেছিলেন।
          ডার্বি আজও হয়। আবেগ টা এখনও একই আছে। বাঙালি ফুটবলার শুধু আজকে আর নেই। আর নেই সে দিনের সেই সব তাসকাকুরা যারা বাড়ি ফেরার পথে একটাও কথা বলেননি। যেন নিকট আত্মীয় কে শেষ বিদায় দিয়ে ফিরে আসছেন সবাই। কয়েক দিন তাসের আড্ডাটাও ঠিক জমেনি। এর কিছুদিনের মধ্যেই মোহনবাগান বোধহয় ইস্টবেঙ্গল কে একটা ডার্বি তে হারিয়েছিল কিন্তু সাতানব্বই এর ডার্বি পরাজয় টা বোধহয় আজও একই ভাবে ওই সকল মানুষকে কষ্ট দেয় যারা মাঠে ছিলেন বা বাইরে থেকে জয় প্রার্থনা করেছিলেন।
          এবছর মোহনবাগানের শিল্ড জেতার কথা যখন বাবা কে বলি তখনও দেখলাম বাবার চোখের কোণে জল। শুধু একটাই কথা বলল আস্তে আস্তে, "কাকে হারালো? ইস্টবেঙ্গল কে?"