আমাদের ভারতবর্ষে ক্রিকেটের প্রতি উন্মাদনা বরাবরই বেশি, আর সেই প্রভাব একদম ছোটবেলা থেকে আমার ওপরও বিস্তারিত হয়েছিল। ফুটবল সেসময় ততটা ভালোও লাগত না। তবে আমার বাবা ছিল মোহনবাগান পাগল! তাই যতই ক্রিকেট ভালোবাসি না কেন নিজের অজান্তেই হয়তো মোহনবাগানের প্রতি একটা টান ছিলই। আর্থিক কারণে বাবা সব খেলা দেখাতে না গেলেও মাঝে মাঝে দেখতাম মোহনবাগানের খেলা দেখতে বেড়িয়ে পড়ছে। বাবা বলত, 'ডার্বি তো, তাই মাঠে যাচ্ছি'। এই খেলা মাঠে বসে দেখার অনুভূতি নাকি বলে বোঝানো যায় না! তখন বুঝতাম না ডার্বি আবার কী? খায় না মাথায় দেয়? কী এমন স্পেশাল এটা? 
                    মোহনবাগানের প্রতি বাবার এই ভালোবাসা দেখে আমারও একদিন মনে হল যে একদিন তো বাবার সঙ্গে খেলা দেখতে গেলেই হয়! যেই ভাবা সেই কাজ। বাবাকে বলেই ফেললাম, 'পরের বার যখন তুমি খেলা দেখতে যাবে আমাকেও নিয়ে যেও।' বাবা বলেছিল, 'আর একটু বড়ো হয়ে যা, তারপর নিয়ে যাব, মাঠে খুব ভিড় হয়'। কিন্তু আমি ভাবলাম তাহলে খেলা দেখব কি করে? কারণ আমাদের পাড়ায় তখন একজনের বাড়িতেই টিভি ছিল। তারা আবার এসব ফুটবল দেখে না! তাই অগত্যা আবার বাবার শরণাপন্ন হলাম। তখন থেকে খেলার দিন যদি আমার পড়াশোনার কোনো কাজ না থাকত তবে বাবা আমাকে কিছুটা দূরে একটা ক্লাবে খেলা দেখতে নিয়ে যেত— ক্লাবটার নাম সবুজ সংঘ, যেখানে আমার প্রথম মোহনবাগানী হয়ে ওঠার হাতেখড়ি।      
                      তখন আমার বয়স ৭-৮ বছর হবে। কিন্তু প্রথমবার খেলা দেখে এই খেলা সম্বন্ধে কিছুই বোধগম্য হলো না। স্বভাবতই খেলাটা আমার ভালো লাগল না একটুও। এদিকে ছোটবেলা থেকেই আমার আবার জেদ প্রচন্ড। যেটা পারব না সেটা করার জন্য যেন একটা নেশা লেগে যায় আমার, আর সেই সুবাদেই ভালো না লাগলেও বাবার সঙ্গে সময় পেলেই চলে যেতাম সবুজ সংঘের বোকাবাক্সের পর্দায় চোখ রাখতে। আস্তে আস্তে বাবার থেকে এবং আরও যারা সেখানে উপস্থিত থাকতেন তাদের থেকে খেলাটা সম্বন্ধে একটা সম্যক ধারণা তৈরী হল। নাহ্, তখনও কিন্তু আলাদা করে মোহনবাগানের প্রতি ভালোবাসা জন্মায়নি। বরং বলা যায় বাবা যেহেতু ওই সবুজ মেরুন জার্সিধারী দলটার জয় চাইত তাই আমিও চাইতাম এই দলটা জিতুক। আর এভাবেই আমার অজান্তেই ঘটতে থাকল আমার সঙ্গে মোহনবাগানের পরিচিতি। 
                      ধীরে ধীরে যখন বাংলা তথা ভারতীয় ফুটবলের সঙ্গে একাত্ম হতে শুরু করলাম, শুরু হলো ইতিহাস আহরণের পালা। এখনকার মতো তখন আমাদের হাতে হাতে মুঠোফোন ছিলো না, জানতামই না ইন্টারনেট জিনিসটা কী! তাই সেসময় ভরসা ছিল পরিচিত কাকু জেঠুরা- যারা আমারও বহুকাল আগে থেকে এই ফুটবল নামক খেলাটার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন। তাদের থেকেই ধীরে ধীরে জানতে শুরু করলাম ময়দানি ফুটবল সম্বন্ধে। জানতে পারি ইষ্টবেঙ্গল ক্লাব নাকি আমাদের মোহনবাগানের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী। শত্রু বললেও ভুল বলা হয় না। ততদিনে মোহনবাগান ক্লাবটার প্রতি ভালোলাগা জন্মাতে শুরু করে দিয়েছে। তারপর থেকে আস্তে আস্তে খেলা দেখার প্রবণতা বাড়তে থাকল, বাড়তে থাকল ফুটবল তথা মোহনবাগানের প্রতি ভালোবাসা। তখন আর বাবার ভরসায় থাকতাম না। মোহনবাগানের খেলা থাকলে নিজেই সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে যেতাম সবুজ সংঘ ক্লাবের উদ্দেশ্যে। একটা আলাদা উত্তেজনার চোরাস্রোত বইত শিঁড়দাড়া দিয়ে, বিশেষ করে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইষ্টবেঙ্গলের সঙ্গে খেলা থাকলে। কিন্তু মাঠের যাওয়ার ইচ্ছেটা অধরাই থেকে গেছিল।
   
                    বাবার কাছে অনেক জেদাজেদি করার পর অবশেষে এল সেই বহু প্রতীক্ষার অবসানের দিন। সালটা তখন ২০০৯। মাসটা ঠিক মনে নেই। আমার বয়স তখন সদ্য ১৫ পূর্ণ হয়েছে। বাবা রাজি হল আমাকে মাঠে নিয়ে যেতে। আর আমি যেই শুনেছি মাঠে যেতে পারব সেই থেকেই উত্তেজনায় ফুটতে শুরু করেছি। দেখতে দেখতে এসে গেল বহু প্রতীক্ষিত সেই দিন। বাবা একটা মোহনবাগানের জার্সি কিনে দিয়েছিল। সেটা  পরে সাইকেল নিয়ে পাড়ি দিলাম আমাদের এখানকার পরিচিত গেরীভাঙ্গা মাঠের দিকে, কারণ সেখান থেকে যাওয়া হবে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন। সেখানে পৌছে দেখি একটা হুড খোলা গাড়ি দাঁড়িয়ে আর সেখানে সব দাদারা মোহনবাগানের পতাকা দিয়ে গাড়িটাকে সবুজ মেরুন রঙে সাজিয়ে তুলছে। তারপর বাবার আদেশে গাড়ির এককোণে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম আর গাড়ি সময় মতো সবাইকে নিয়ে রওনা দিল গন্তব্যের উদ্দ্যেশে। আমি তখনও একটা ঘোরের মধ্যে আছি। গাড়িতে চলছে স্লোগান আর সেগুলো সমস্বরে উচ্চারিত হচ্ছে, কিন্তু আমি সেসব জানি না। তাই চুপচাপ দাড়িয়েই সেগুলো উপভোগ করতে থাকলাম। ধীরে ধীরে যখন আমাদের গাড়ি প্রায় মাঠের কাছাকাছি চলে এসেছে তখন দেখি আমাদের মতোই আরও কত গাড়ি— কোনো গাড়ি সবুজ মেরুন রঙে রাঙানো তো কোনো গাড়ি লাল হলুদ, এছাড়াও অনেকে পায়ে হেঁটে বা বাসেও রওনা দিয়েছে মাঠের উদ্দ্যেশ্যে। প্রত্যেক দলের সমর্থকরা একে অপরের উদ্দ্যেশ্যে বাক্যবাণ ছুঁড়ে দিয়ে নিজের অস্তিত্ব জাহির করা চেষ্টা করছে। এই সব দেখতে দেখতে কখন পৌঁছে গেলাম স্টেডিয়ামের সামনে সেটা বুঝতেও পারলাম না। গাড়ি থেকে নেমে দেখি চারিদিকে লোকে লোকারণ্য, এত লোক আমি কলকাতার দুর্গাপুজোয় ছাড়া কোনোদিন একসাথে দেখিনি। এইসব দেখতে দেখতেই বাবার হাত ধরে গেটে টিকিট দেখিয়ে প্রবেশ করলাম স্টেডিয়ামের ভেতরে৷ ভেতরে প্রবেশ করে আমার চোখ তো ছানাবড়া! আমার দেখা বোকাবাক্সতে একদমই বোঝা যায় না এই স্টেডিয়ামের বিশালতা। এর আগে আমার স্টেডিয়াম  দেখা বলতে বালির 'নবীন সংঘ' ক্লাবের আয়োজিত ফুটবল টুর্নামেন্টের অস্থায়ী স্টেডিয়াম যেখানে মেরে কেটে হয়তো ৫০০ লোক বসতে পারত। পরে বাবার মুখে যুবভারতীর আসন সংখ্যা শুনে চমকে গেছিলাম। যাক সেসব তো হলো, এবার খেলা শুরু হওয়ার পালা। প্রথম বাঁশি বাজার সাথে সাথেই ঠাকুরকে ডেকেছিলাম— আজ প্রথম আমার মাঠে আসা, আজ যেন আমার মোহনবাগান যেতে। হ্যাঁ, "আমার মোহনবাগান"- কারণ আমি সেইদিন মোহনবাগানের প্রতি সবথেকে বেশী আকর্ষণ অনুভব করেছিলাম। 
                    সেদিন ঈশ্বর আমার কথা ফেরাননি। আমরা ৫-৩ গোলে ইষ্টবেঙ্গলকে পরাস্ত করেছিলাম। প্রথমবার মাঠে গিয়ে থেকেছিলাম এক ইতিহাসের সাক্ষী। সেই আনন্দে বাড়ি ফেরার সময় নিজের হাতখরচা বাঁচানো টাকা থেকে মায়ের জন্য মিষ্টি কিনে এনেছিলাম। সেই থেকে আজ অবধি মাঠে গেছি, মোহনবাগান জিতেছে, কিন্তু মায়ের জন্য মিষ্টি আনিনি এমনটা হয়নি। 
                    সেদিনের পর থেকে কলকাতায় বড়ম্যাচ হয়েছে আর আমি স্টেডিয়ামে যাই নি সেটা কোনোদিনও হয় নি। আর এই ম্যাচগুলো দেখতে টিকিটের জন্য যিনি সব থেকে বেশি সাহায্য করেছিলেন তিনি হলেন প্রদীপ দা, একজন মোহনবাগানের অন্ধ ভক্ত। প্রদীপদা ২০২৩ সালে যখন অকালে মৃত্যুবরণ করেন তখন শুরু হল আমারও টিকিটের সংকট। কারণ অফিসের কাজ ফেলে টিকিট কাটতে যাওয়া প্রায় অসম্ভব, কোনো মতে জোগাড় করতে পেরেছিলাম ডুরান্ড কাপ ২০২৩-এর ফাইনালের টিকিট। তারপর থেকে মনে একটা চিন্তা এসে গেল যে টিকিট কীভাবে পাব এবার? প্রত্যেকবার এরকমভাবে ছোটাছুটি করে টিকিট জোগাড় করা অসম্ভব। ঠিক তার কিছুদিন পর ফেসবুকে একটা পোষ্ট চোখে আসে। যেখানে এক মোহনবাগান ফ্যান্স ক্লাব নাকি তাদের সদস্য হলে টিকিটের ব্যাবস্থা করে দেবে বলে জানায়। হ্যাঁ, শুধুমাত্র "টিকিটের লোভেই" যুক্ত হওয়া সেই ফ্যান্স ক্লাব 'মেরিনার্স এরিনা'তে। প্রথম থেকেই ধারণা ছিল- যাব, টিকিট নেব, খেলা দেখব, ব্যাস! সেই মতোই ISL-এর ম্যাচ গুলো মেরিনার্স এরিনার মাধ্যমে টিকিট কিনে খেলা দেখা শুরু করি।
                    কিন্তু আমার ওই ভাবনার ইতি ঘটল অচিরেই। ধীরে ধীরে পরিচিত হতে থাকলাম মেরিনার্স এরিনার সহ-মোহনবাগানীদের সঙ্গে, আর মেরিনার্স এরিনাও মোহনবাগানের মতো একসূতোয় বেঁধে গেল নিজের সাথে। আগে যেখানে শুধু ডার্বি ছাড়া খেলা দেখতে যাওয়া হত না সেখানে এখন মেরিনার্স এরিনার দৌলতেই সমস্ত ঘরের মাঠের খেলা এবং কিছু বাইরের খেলাও দেখতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। বর্তমান অবস্থায় মোহনবাগান যেখানে নিজের মায়ের জায়গা করে নিয়েছে তেমনই মেরিনার্স এরিনাও একটা পরিবার হয়ে উঠেছে। 
                    সর্বশেষে বলতে পারি জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অবধি নিজের মায়ের মতো মোহনবাগানের সমস্ত সুখ দুঃখে পাশে থাকার অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছি এবং ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি যদি পরজন্ম বলে কিছু থেকে থাকে তাহলে পরজন্মেও যেনো নিজেকে মোহন মায়ের পায়ে নিজেকে সমর্পিত করতে পারি।