ভবানীপুরের কীর্তি মিত্রের বাসভবন 'মোহনবাগান ভিলা'র নামে নামাঙ্কিত ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে গড়ে ওঠা একটা 'সংগঠন' যে একবিংশ শতাব্দীর পথরেখা তরতর করে সগৌরবে অতিক্রম করে যাবে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা অগণিত ভক্তবৃন্দের মাথায় চেপে; তা কি বিধির বিধান খচিত ছিল? নিশ্চয়ই ছিল। তা না হলে টাইমস্ স্কোয়ার থেকে ফিফার সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট, কেন সর্বত্রই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ফুটবলে তৃতীয় বিশ্বের এই দেশের একটিই মাত্র ফুটবল ক্লাব? ক্লাব গড়ে ওঠে খেলাধূলার প্রচার-খেলোয়াড়দের ব্যাপ্তি ঘটানোর লক্ষ্যে; কিন্তু এ তো এক নিখাদ সংগঠন, যা বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন পরিস্থিতিতে জাত-ধর্ম নির্বিশেষে বটবৃক্ষের মতো করে নিজেকে মেলে ধরে সকলকে ছায়া জুগিয়েছে। এক আর্টিকেলে পড়েছিলাম, "ইস্টবেঙ্গল মূলতঃ বাঙাল-নির্ভর ক্লাব হলেও মোহনবাগান শুধুই ঘটিদের নয়।" কেন নয়, তার উত্তর পেতে গিয়ে জানলাম ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধাদের অর্থ সাহায্যার্থে একমাত্র মোহনবাগান ক্লাবই একটি প্রীতি ম্যাচের আয়োজন করে। কিছু আইনগত জটিলতার কারণে মোহনবাগান সেদিন 'গোষ্ঠ পাল একাদশ' নামে খেলে এবং খেলা থেকে প্রাপ্ত সম্পূর্ণ অর্থই মুক্তিযোদ্ধাদের দান করে দেওয়া হয়। বরাবরই যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেওয়া যেন স্বভাবে পরিণত করেছে গঙ্গাপাড়ের এই ক্লাব। আরেকটি আলোড়ন ফেলে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত : সাল ১৯৪৩, ভারতবর্ষ তখনো ব্রিটিশদের অধীনে। 'মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাব' থেকে ঘোষণা করা হলো নিজেদের খেলোয়াড়দের জন্য বীমার কথা। এক পরাধীন দেশের ক্লাবের খেলোয়াড়রাও কিনা বীমার সুবিধা ভোগ করতে পারবেন! যা ভাবাও ছিল অসম্ভব, তাকে বাস্তব রূপ দিল মোহনবাগান। একমাত্র মোহনবাগানই পেরেছে এবং এখনো পারে।
          আমার 'মোহনবাগানী' হয়ে ওঠার পিছনে এই গল্পগুলোই যথেষ্ট হওয়া সত্ত্বেও আমি এগুলোর সংস্পর্শে এসেছি পুরোদস্তুর মোহনবাগানী হয়ে ওঠার পর। বাড়িতে খেলার চর্চা আমি জন্ম থেকেই দেখে আসছি; বাবা একজন সফল ফুটবলার নদীয়া জেলা পুলিশ টি মের। ছোটো থেকেই ময়দানে প্র্যাকটিসের সুবাদে প্রায় সমস্ত নামকরা বাঙালি ফুটবলারদের সংস্পর্শে এসেছেন। মোহনবাগান নিয়ে অল্প-বিস্তর গল্প বাবার মুখেই শোনা বাকি আরো পাঁচজন মোহনবাগানীর মতোই। কিন্তু তখন আমি ক্রিকেট-প্রেমী। হরভজনের বোলিং অ্যাকশন থেকে শ্রীশান্তের সেলিব্রেশন — পুরোটাই ছিল ঠোঁটস্থ। তারপর ২০০৯-এর এক সন্ধ্যায় আমার প্রথম ডার্বি দেখা। প্রদীপ-মানসের সরল অথচ রোমাঞ্চকর সেই ধারাভাষ্য মনে থাকবে বহু বছর। রেনেডি সিং-এর ফ্রী-কিক থেকে মিত্রোভিচের করা গোলের পর যখন মোহনবাগান সমর্থকরা জেতার আশা ছেড়ে দিয়েছেন, তখনই মাঠে জাদু ছড়ালেন এক নাইজেরিয়ান; হ্যাঁ, চিডি এডে। ফলাফল যা হওয়ার তাই হলো : ৫-৩ মোহনবাগানের পক্ষে। ওটাই আমার মোহনবাগানী হয়ে ওঠা এবং "মোহনবাগান মোমেণ্ট"। মোহনবাগানে খেলে যাওয়া বিদেশিদের মধ্যে আমার কাছে প্রথম তাক লাগানো বিদেশি তখন চিডিই। তার কয়েক বছর পর খেলা দেখলাম ওডাফার, ডেম্পোর বিরুদ্ধে সেই অসাধারণ গোল। তারপর সঞ্জয় সেনের কোচিংয়ে মোহনবাগানের আই লীগ জয়। ব্যাঙ্গালোরের বিরুদ্ধে বেলো রাজ্জাকের দুরন্ত হেডার, এবং গোল। ক্রমে মোহনবাগানে কর্পোরেট ছোঁয়া লাগল, বদলালো কর্মকর্তাদের নামের তালিকাও। কিন্তু মোহনবাগান চলেছে মোহনবাগানেরই মতো; দাঁড় উঁচিয়ে, পাল তুলে। ১৯১১-এর ইউনিয়ন জ্যাক থেকে শুরু করে ২০২২ এর এ.টি.কে. — দু'টোই সরানো মোহনবাগানের জন্য কঠিন ছিল, কিন্তু অসম্ভব নয় এবং মোহনবাগান তা করে দেখিয়েছে। আমার চোখে মোহনবাগানে খেলে যাওয়া সেরা বিদেশিদের মধ্যে অবশ্যই সর্বপ্রথম স্থানে থাকবে হাইতিয়ান জাদুকর সোনি নর্দে। তারপর বেইতিয়া-মুনোজদের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে অজি খেলোয়াড় পেত্রাতোসের নাম না বললেই নয়। আমার কাছে 'মোহনবাগান' মানে 'নায়ক' সিনেমার অরিন্দম মুখার্জীর চরিত্রে উত্তম কুমারের টেবিল চাপড়ে করা বিখ্যাত সেই উক্তি "আই উইল গো টু দ্য টপ্ !" কালের নিয়মে ২০২৩-২৪ সিজনের শেষে আই.এস.এল এবং ডুরাণ্ডের মতো দুই নব্য অথচ প্রসিদ্ধতম এবং ঐতিহ্যবাহী দুই লীগেই মোহনবাগানের অবস্থান কিন্তু সেই 'টপ্' অর্থাৎ শীর্ষেই। বর্তমানে মোহনবাগান সুপার জায়েন্টের এক বহুল জনপ্রিয় ফ্যান্স-ক্লাব 'মেরিনার্স এরিনা'র সদস্য আমি। আমাদের ধ্যান-জ্ঞান একটাই -- মোহনবাগান। "মোহনবাগানই আমাদের ধর্ম, মোহনবাগানই আমাদের কর্ম"।
তবে মোহনবাগান মাঠে গিয়ে মোহনবাগানের খেলা না দেখার দুঃখ সবসময় মনের মধ্যে রয়েছে। কবে সেই সুযোগ হবে, তার অপেক্ষায় আছি...